শ্রীলঙ্কা : রত্নের কিংবদন্তি
শ্রীলঙ্কা, যা একসময় ছিল সেলোন, সিলাঁও এবং সারান্ডিব নামে পরিচিত, প্রায় ২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রঙিন রত্নের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপ দেশটি বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান পাথরের জন্য বিখ্যাত—সাফায়ার, রুবি, স্পাইনেল, টোপাজ, মুনস্টোন, ক্রাইসোবেরিল, গার্নেট, জিরকন, টুরমালাইনসহ অসংখ্য বিরল রত্ন এখানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে নীলকান্তমণির নীল ও তারকার মতো বিচিত্র বৈচিত্র্য শ্রীলঙ্কাকে অনন্য করে তুলেছে।
ইতিহাস বলছে, রোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমি দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই দ্বীপে সাফায়ার ও বেলের প্রাচুর্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে পার্সিয়ান, আরব এবং চীনা বণিকেরা নিয়মিতভাবে এখানে আসতেন রত্ন সংগ্রহ করতে। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা সারান্ডিব আবিষ্কার করে এর নাম দেন সিলাঁও, যা পরবর্তীতে ইংরেজিতে Ceylon নামে পরিচিত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ‘serendipity’ শব্দটির উৎসও এই সারান্ডিব থেকেই—অপ্রত্যাশিতভাবে মূল্যবান জিনিস আবিষ্কারের ঘটনা। এরপর ডাচ এবং ইংরেজ উপনিবেশ শাসনের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা রত্নশিল্পে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে।
ভূতাত্ত্বিকভাবে প্রায় দুই বিলিয়ন বছরের পুরোনো প্রাকক্যাম্ব্রিয়ান শিলায় সমৃদ্ধ এই দ্বীপের ২৫টি রত্নক্ষেত্র থেকে ১০ প্রজাতির ও ৭৫ ধরনের রত্ন পাওয়া গেছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভূখণ্ড রত্নসমৃদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত। প্রথাগত খনন পদ্ধতিতে শ্রমিকরা মাটি খুঁড়ে, লোহার দণ্ড দিয়ে পরীক্ষা করে এবং ঝুড়িতে ধুয়ে রত্ন সংগ্রহ করেন। যন্ত্রচালিত খনির পরিবর্তে এই পদ্ধতি পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হলেও উৎপাদন কম, তবুও সরকার পরিবেশ ও কর্মসংস্থান বজায় রাখতে সীমিত পরিসরে যন্ত্রের ব্যবহার অনুমোদন করেছে। দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার রত্ন রাজধানী রত্নাপুরা—সিনহাল ভাষায় যার অর্থ “রত্নের শহর”। এখান থেকেই আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের বিখ্যাত সাফায়ার, যেমন ৪২৩ ক্যারেটের লোগান সাফায়ার, ৩৯৫ ক্যারেটের ব্লু বেলা, ১,৪০৪ ক্যারেটের স্টার অফ অ্যাডাম এবং আরও অনেক কিংবদন্তি রত্ন।
স্বাধীনতা অর্জনের পর নানা সংকট পেরিয়েও আজ শ্রীলঙ্কার রত্নশিল্প আবার জেগে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ এই শিল্পে কর্মরত এবং বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। ‘রত্নদ্বীপ’ নামে খ্যাত এই দেশ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের এক অনন্য সমাহার হিসেবে আজও বিশ্ববাজারে আলো ছড়াচ্ছে।